চিকিৎসা গবেষণা: পাট থেকে নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের সন্ধান পেয়েছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা

  • মিজানুর রহমান খান
  • বিবিসি বাংলা, লন্ডন
পাট ক্ষেত

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

পাট থেকে এই অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে।

(এবিষয়ে রেডিওতে বিস্তারিত শুনতে পাবেন, ২৩শে জুন বুধবার, বিবিসি বাংলার রাতের অনুষ্ঠান পরিক্রমায়, বিজ্ঞানের আসরে)

চিকিৎসা বিজ্ঞানে জীবাণু-প্রতিরোধী অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নিয়ে যখন ক্রমশই উদ্বেগ ও হতাশা বাড়ছে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী একেবারে নতুন ধরনের একটি অ্যান্টিবায়োটিকের সন্ধান পেয়েছেন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই অ্যান্টিবায়োটিকের গঠন ও বৈশিষ্ট্য দেখে মনে হচ্ছে যে এটি শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষের জীবন বাঁচাতে পারবে বলে তারা আশা করছেন।

পাট থেকে এই অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করা হয়েছে যার নাম দেওয়া হয়েছে হোমিকরসিন। প্রাপ্ত ব্যাকটেরিয়া ও পাটের বৈজ্ঞানিক নাম মিলিয়ে এই অ্যান্টিবায়োটিকটির নামকরণ করা হয়েছে।

বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী নেচারের সায়েন্টিফিক রিপোর্টসে সম্প্রতি এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ল্যাবে তিন বছর ধরে গবেষণার পর এই অ্যান্টিবায়োটিকের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের শিক্ষক ড. হাসিনা খানের নেতৃত্বে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি পাট নিয়ে গবেষণা করছেন।

বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, পাটের জীবন রহস্য উদঘাটনের সময় তিনি এর ভেতরে বিভিন্ন ধরনের অণুজীবের সন্ধান পেয়েছিলেন। এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই তিনি বিভিন্ন অণুজীবের ওপর গবেষণা শুরু করেছিলেন। তার এক পর্যায়ে অনেকটা আকস্মিকভাবেই তিনি এই অ্যান্টিবায়োটিকের সন্ধান পান।

হাসিনা খান বলেন, "এটা অনেকটা অপ্রত্যাশিতই বলবো। পাট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি পাটের অণুজীবের সন্ধান পেলাম। তখন সেগুলোকে খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হলো।"

ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজ চলছে।

ছবির উৎস, Biochemistry & Molecular Biology Dept

ছবির ক্যাপশান,

ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজ চলছে।

"প্রত্যেক উদ্ভিদের সাথেই বসবাস করে কোটি কোটি অণুজীব। এরা উদ্ভিদের জন্য নানা ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করে। এছাড়াও আরো কিছু অণুজীব আছে যারা আমাদেরও কাজে আসে। তো আমরা এরকম এক অণুজীবের সন্ধান পেলাম যা অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে," বলেন তিনি।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, পাটের তন্তুর খাঁজে খাঁজে বহু অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়া বাস করে। এদের মধ্যে তারা একটি ব্যাকটেরিয়ার খোঁজ পান যা তার নিজের শরীর থেকে এমন কিছু তৈরি করে, যাতে অন্য ব্যাকটেরিয়াগুলো মারা যায়।

যে অণুজীবের ভেতরে তারা অভিনব এই ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পান সেটি তারা পেয়েছেন পাটের বীজের ভেতরে। তারা দেখলেন স্টেফাইলোকক্বাস হোমিনিস নামের এই ব্যাকটেরিয়াটি একটি অ্যান্টিবায়োটিকের মতো কাজ করছে।

বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, যাদের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না, অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে অণুজীবের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, তাদের চিকিৎসায় এই হোমিকরসিন অ্যান্টিবায়োটিক ভালোভাবেই কাজ করবে।

আরো পড়তে পারেন:

হাসিনা খান

ছবির উৎস, Haseena Khan

ছবির ক্যাপশান,

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সুপরিচিত বাংলাদেশের বিজ্ঞানী হাসিনা খান।

সুপারবাগ নামে পরিচিত যেসব ব্যাকটেরিয়া প্রচলিত কোনো অ্যান্টিবায়োটিকেই কাবু হয় না, তাদের সাথে লড়াই-এ হোমিকরসিন সফল হবে বলে তারা আশা করছেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে বর্তমানে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে তার অনেকগুলোই জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে এবং দিনে দিনে আরো অনেক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠছে। অর্থাৎ অনেক অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গেই অনেক জীবাণু খাপ খাইয়ে নিয়েছে।

একারণে সারা বিশ্বেই অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানান, তারা যে হোমিকরসিন অ্যান্টিবায়োটিকের সন্ধান পেয়েছেন সেটি বেশ কিছু শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ভালো কাজ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ট্যাবলেট।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

হাসিনা খান বলেন, "এটার গঠনটা এমন যে তার বিরুদ্ধে অণুজীবরা তাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। একেবারেই যে পারে না সেটা বলবো না, সহজে পারে না। আমরা দেখেছি সুপারবাগের বিরুদ্ধেও এটা ভালো কাজ করে। আমাদের মনে হয় যে এর বিরুদ্ধে তারা সহজেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। এনিয়ে আমাদের ভয়ও খুব কম।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা তাদের আবিষ্কৃত অ্যান্টিবায়োটিকের পাঁচটি ভ্যারিয়্যান্ট বা ধরনের সন্ধান পেয়েছেন। এর মধ্যে দুটো ভ্যারিয়্যান্টের কথা সায়েন্টিফিক রিপোর্টস জর্নালে উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি তিনটি ভ্যারিয়্যান্টের কার্যকারিতা নিয়ে এখনও গবেষণা অব্যাহত রয়েছে।

বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই পাঁচ রকমের ভ্যারিয়্যান্ট থেকে অন্তত পাঁচটি অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা যেতে পারে যা চিকিৎসা বিজ্ঞানে তৈরি করতে পারে নতুন এক ইতিহাস।

তবে এই হোমিকরসিন অ্যান্টিবায়োটিক এখনই চিকিৎসায় ব্যবহার করা যাবে না। এনিয়ে আরো গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।

ড. হাসিনা খান বলেন, "এটা নিয়ে আরো কাজ করতে হলে যেটা প্রথমেই দরকার সেটা হলো এর প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন। যে অণুজীবের জেনেটিক্স আমাদের জানা এবং যা আমরা সহজেই জন্মাতে পারি তার ভেতরে অ্যান্টিবায়োটিকের জিনগুলো প্রবেশ করানো হবে। সেই অণুজীবের মধ্যেই অ্যান্টিবায়োটিকটির উৎপাদন আমরা বাড়াবো।"

তিনি জানান যে অনেক ওষুধ এভাবেই তৈরি করা হয়েছে। ইনসুলিন এভাবেই তৈরি হয়।

আরো পড়তে পারেন:

"অ্যান্টিবায়োটিকটি বেশি পরিমাণে পেলে সেটি ইঁদুরে বা সিল্ক ওয়ার্মের দেহে পরীক্ষা করে দেখতে হবে এটি কতোটা কার্যকর।"

তিনি বলেন, "এর যে গঠন তার কারণে এটি মানুষের শরীরে প্রবেশের পর দেহের এনজাইম এটিকে ভেঙে ফেলতে পারে। আমাদের এটাও ভেবে দেখতে হবে এই অ্যান্টিবায়োটিক কিভাবে শরীরে প্রবেশ করানো যায় যাতে এটি শরীরের ভেতরে গিয়ে না ভাঙে।"

কাঁচা পাট।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

পাটের মতো সব উদ্ভিদেই আছে কোটি কোটি অণুজীব।

তিনি জানান যে ইতোমধ্যে তারা নতুন অ্যান্টিবায়োটিকটিকে বিশুদ্ধ করেছেন এবং এর গঠন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়েছেন।

"এধরনের অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে কিন্তু খুব সহজেই ল্যাবরেটরিতে পরিবর্তন করা যায়। পরিবর্তন করে এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা যায়। এরকম কিছু কাজ আমরা পরে করবো। কিন্তু এমুহূর্তে কাজ হচ্ছে- এর প্রচুর উৎপাদন এবং শরীরের ভেতরে এটা কিভাবে কাজ করবে সেটা দেখা।"

তিনি বলেন, শুধু এসব কাজের জন্য যদি একটি ল্যাব পাওয়া যেত তাহলে তিন বছরের মধ্যেই এই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের জন্য তৈরি করা যেত। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে কাজ চলছে তাতে পাঁচ থেকে ছয় বছরেরও বেশি সময় লেগে যাবে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই আবিষ্কারের কয়েকটি তাৎপর্য রয়েছে: ১. বিশেষ গঠনের কারণে এই অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা ২. এটি প্রতিরোধ করা কঠিন ৩. ল্যাবরেটরিতে এটি পরিবর্তন করা সহজ ৪. পরিবর্তন করে কার্যাকারিতা বাড়ানো যাবে এবং ৫. প্রাকৃতিকভাবে এর উৎপাদন হবে সাশ্রয়ী।

হাসিনা খান ছাড়াও এই গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও জিন প্রকৌশল বিভাগের সাতজন গবেষক যুক্ত ছিলেন। এরা হলেন: ড. এম আফতাব উদ্দিন, ড. মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম, শাম্মী আক্তার, মাহবুবা ফেরদৌস, বদরুল হায়দার, আল আমিন এবং এ এইচ এম শফিউল ইসলাম মোল্লা।