কেন বন্ধু প্রতিবেশীরা ভারতকে ছেড়ে যাচ্ছে? প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের কী রায়?

  • শুভজ্যোতি ঘোষ
  • বিবিসি বাংলা, দিল্লি
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর একটিই সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে। কাঠমান্ডু, ২০১৪

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর একটিই সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে। কাঠমান্ডু, ২০১৪

ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস মনে করছে, মোদী সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে নিজেদের নেইবারহুড বা প্রতিবেশে ভারত 'বন্ধু'দের হারিয়ে এক বিপজ্জনক পথে এগোচ্ছে।

দলের শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধী টুইটারে এই মন্তব্য করার পাশাপাশি 'দ্য ইকোনমিস্ট' সাময়িকীর একটি লিঙ্কও জুড়ে দিয়েছেন, যাতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যখন দুর্বল হচ্ছে তখনই কিন্তু তারা চীনের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

কিন্তু বাংলাদেশ-সহ প্রতিবেশী দেশগুলোর ক্ষেত্রে মোদী সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে ঠিক কোথায় ভুল হচ্ছে বলে কংগ্রেসের ধারণা? বিজেপি নেতৃত্বই বা এই অভিযোগের জবাবে কী বলছে?

বস্তুত সোয়া ছ'বছর আগে নরেন্দ্র মোদী সরকার ভারতের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দিল্লির পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল কথা হল 'নেইবারহুড ফার্স্ট' - যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় 'সবার আগে প্রতিবেশীরা'।

কিন্তু প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীর দাবি, এই বন্ধু প্রতিবেশী দেশগুলোই এখন একে একে ভারতকে ছেড়ে যাচ্ছে - আর এ প্রসঙ্গেই তিনি দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন।

কংগ্রেসের ওয়েবসাইটে তাদের পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত দলিলের প্রচ্ছদ

ছবির উৎস, AICC

ছবির ক্যাপশান, কংগ্রেসের ওয়েবসাইটে তাদের পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত দলিলের প্রচ্ছদ

বিগত বহু দশক ধরে এই প্রতিবেশীদের সঙ্গে কংগ্রেস যে 'সুসম্পর্কের জাল' তৈরি করেছিল মোদী সরকার সেটাও ধ্বংস করে ফেলছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

কংগ্রেসের মতে তাহলে ভুলটা কোথায় হচ্ছে?

ভারতের শেষ কংগ্রেসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সালমান খুরশিদ। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, "প্রতিবেশী দেশগুলো আজ আমাদের প্রতি কতটা বন্ধুত্বপূর্ণ সেটা তো আর তর্কের বিষয় নয় - চোখের সামনে দেখাই যাচ্ছে।"

"এই জন্যই আমাদের দলনেতা বলেছেন আমরা খুব দ্রুত বন্ধুদের হারাচ্ছি, যদি না এর মধ্যেই পুরোপুরি হারিয়ে থাকি।"

"আসলে ভারতের বর্তমান সরকার ঘরোয়া রাজনীতিতে নিজেদের দৈত্য বলে মনে করে, যাদের কোনও পরামর্শ বা সহযোগিতা লাগেই না - আর তাদের পররাষ্ট্রনীতিতেও ঠিক সেটারই প্রতিফলন ঘটছে।"

"আফ্রিকা থেকে আসিয়ান, মধ্য এশিয়া-আরব কিংবা নেইবারহুড চিরকাল আমরা সব দেশকে 'ইক্যুয়াল পার্টনার' ভেবে এসেছি, শক্তি-সামর্থ্য-অর্থনীতিতে ফারাক থাকলেও কখনও সেটা তাদের মনে করাতে যাইনি।"

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ

"আজ ভারতের বিরাট বাজার, দুনিয়ায় শক্ত অবস্থান ও শক্তিশালী আর্মি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা স্বেচ্ছাচারীর মতো আচরণ করতে পারব। মূল সমস্যা হল প্রতিবেশীদের সঙ্গে এই সমতার ভাবনাটাই আমরা ত্যাগ করেছি", বলছিলেন মি খুরশিদ।

দিল্লিতে বিজেপি-র পলিসি রিসার্চ সেলের অনির্বাণ গাঙ্গুলি অবশ্য একথা মানতেই রাজি নন যে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশীরা ভারতকে ছেড়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে দ্য ইকোনমিস্ট বা রাহুল গান্ধীর মতামতকেও নস্যাৎ করে দিচ্ছেন তিনি।

ড: গাঙ্গুলির কথায়, "রাহুল গান্ধী আন্তর্জাতিক রাজনীতি কতটা বোঝেন তা নিয়ে মন্তব্য না-করাই ভাল। আর ইকোনমিস্ট-ও এমন একটা জার্নাল যারা দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত ভারতকে বোঝে না বললেই চলে!"

"যে ইকোনমিস্ট বলেছিল নরেন্দ্র মোদীকে নির্বাচিত করে ভারতের ভোটাররা বুঝিয়ে দিয়েছে তারা অপরিণত, তাদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কোনও মন্তব্য করাটাও বোধহয় সুস্থ মস্তিষ্কের লক্ষণ নয়।"

"আর আপনি মিয়ানমার থেকে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশ - গত কয়েক মাসে ভারতের প্রতি এ সব দেশের সরকারপ্রধানদের বিবৃতিগুলোই মিলিয়ে দেখুন, তাহলেই বোঝা যাবে এই বক্তব্য কতটা ভিত্তিহীন।"

বিজেপির পলিসি রিসার্চ সেলের অনির্বাণ গাঙ্গুলি

ছবির উৎস, Anirban Ganguly/Facebook

ছবির ক্যাপশান, বিজেপির পলিসি রিসার্চ সেলের অনির্বাণ গাঙ্গুলি

"এই যে বলা হচ্ছে আমরা বন্ধুদের হারাচ্ছি, তো এই বন্ধুরা ভারতকে ছেড়ে যাচ্ছেটা কোথায়?" পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন তিনি।

আরও পড়তে পারেন:

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, সিনিয়র কংগ্রেস এমপি ও বর্তমানে বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সদস্য পরনিত কাউরের কাছে অবশ্য এ প্রশ্নের একটা সহজ জবাব আছে - "এই দেশগুলো চীনের দিকে ঝুঁকছে"।

মিস কাউর বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "বেশ কয়েক বছর আগেও আমাদের নেইবারহুডে যে পরিস্থিতি ছিল তার চেয়ে এখন অনেকটাই আলাদা।"

"কারণ এখানে চীনের প্রভাব বাড়ছে আর সেটা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির জন্যও খুব উদ্বেগের বিষয়।"

অনির্বাণ গাঙ্গুলি অবশ্য দাবি করছেন, নেপাল কিংবা বাংলাদেশে কোথাও এমন কিছু ঘটেনি যাতে ভারত প্রমাদ গুণবে।

Skip Twitter post, 1
Twitter কনটেন্টের জন্য কি অনুমতি দেবেন?

এই নিবন্ধে Twitterএর কনটেন্ট রয়েছে। কোন কিছু লোড করার আগে আমরা আপনার অনুমতি চাইছি, কারণ তারা হয়ত কুকি এবং অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকতে পারে। আপনি সম্মতি দেবার আগে হয়ত Twitter কুকি সম্পর্কিত নীতি এবং ব্যক্তিগত বিষয়ক নীতি প়ড়ে নিতে চাইতে পারেন। এই কনটেন্ট দেখতে হলে 'সম্মতি দিচ্ছি এবং এগোন' বেছে নিন।

End of Twitter post, 1

তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, "এই তো আমাদের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে দেখা করে এলেন। বাংলাদেশের ফার্মা কোম্পানি যে ভারতের সঙ্গে মিলে কোভিড ভ্যাক্সিন বানাবে, সে কথাও হল।"

"মিয়ানমারের জেনারেলরাও গত কয়েক মাসে ভারতের প্রতি কী বার্তা দিয়েছেন, সেটাও কংগ্রেসকে খোঁজ নিতে বলব।"

"নেপালেও প্রধানমন্ত্রী যখন সে দেশের পার্লামেন্টে ভারত-বিরোধী প্রস্তাব পাস করাচ্ছেন, আমরা তখন কাঠমান্ডুর পশুপতিনাথ মন্দিরে ব্যাপক সংস্কারের কাজ করছি, সিউয়েজের লাইন বসাচ্ছি।"

"কাজেই ভারত বিশ্বাস করে সম্পর্কটা দুদেশের মানুষের মধ্যে। সরকার আজ আছে, কাল নেই - কিছু আসে যায় না।"

সালমান খুরশিদ কিন্তু মনে করিয়ে দিচ্ছেন, "মুখে বাংলাদেশকে মিষ্টি কথা বলব আর আসামের বিপুল জনসংখ্যাকে রাতারাতি বাংলাদেশি তকমা দিয়ে দেব, এটা তো হয় না।"

কংগ্রেসের সিনিয়র এমপি ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পরনিত কাউর

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, কংগ্রেসের সিনিয়র এমপি ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পরনিত কাউর

"সুসম্পর্ক চাইলে বাংলাদেশ কোন বিষয়গুলোতে স্পর্শকাতর, সেটা আমাদের আচরণে খেয়াল রাখতে হবে।"

"অনুপ্রবেশ সমস্যা মোকাবিলা করতে চাইলে ঠান্ডা মাথায় ঢাকাকে বোঝানো হোক, বলা হোক তোমাদেরই পরিবার এ দেশে রয়ে গেছে - ওদের ফিরিয়ে নাও, আমরাও সাহায্য করব।"

"তার বদলে আমরা কী বলছি, না বাংলাদেশিদের ছুঁড়ে ফেলে দেব!"

এই ঔদ্ধত্য আর হঠকারিতাই বন্ধু প্রতিবেশীদের মধ্যে ভারতের ভাবমূর্তিকে তলানিতে নিয়ে এসেছে বলে কংগ্রেসের বক্তব্য।

যদিও ক্ষমতাসীন বিজেপি সেই সমালোচনা গায়ে মাখছে এখনও তেমন কোনও ইঙ্গিত নেই।